ইতিহাস তৈরি করল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুরাইয়ার পিএইচডি অর্জন

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুরাইয়ার পিএইচডি অর্জন

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুরাইয়ার পিএইচডি অর্জন

সুরাইয়া আকতারের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুরাইয়া যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে ও বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারীর পিএইচডি অর্জন। তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল প্রতিবন্ধিতা ও নারী। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধিতা ও কর্মসংস্থান বিষয়ে পিএইচডি করেছেন তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান। আজ থেকে প্রায় ৪ বছর আগে তাঁদের সঙ্গে ৪ বছর ৩ মাস বয়সী ছেলে শেহরান সানিম রহমানও পাড়ি জমিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। এই পরিবার ২৭ জুলাই ২০১৮ সালে রাতে রওনা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে।

স্ত্রী সুরাইয়া আক্তারের পিএইচডি শেষ করার পর স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠানের ছবি পোস্ট করে মিজানুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, বিয়ের প্রথম দিনই স্ত্রীর কাছে স্ত্রীর স্বপ্নের কথা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবা খুব খুশি হবেন যদি তিনি বিশ্বের নামকরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করতে পারেন। মিজানুর লিখেছেন, সেই দিনই তিনি তাঁর স্ত্রীর এই স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। এখন স্ত্রীর সেই স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে।

প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান। ২০০৮ সালে গড়ে তোলেন ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের অন্যতম প্রধান কাজ সমাজের স্বাভাবিক মানুষদের প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিডিএফের কমিটি কাজ করছে। শিক্ষার্থীরা এসব কমিটি পরিচালনা করছেন। আর মিজানুর রহমান ছিলেন এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে সংগঠনের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সুরাইয়ার জীবনের গল্পটা অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা। ২০১৫ সালে সুরাইয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। তিনি ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। সেই সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল মিজানুর রহমানের সঙ্গে। মিজানুরও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে পড়াশোনা করেছেন। পরিবার ও সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে ২০১২ সালে তিনি সুরাইয়াকে বিয়ে করেন। দুজন মিলে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরবেন—এমনই ইচ্ছা ছিল।

নীলফামারীর মেয়ে সুরাইয়া। তিনি জন্মগতভাবে রেটিনার সমস্যায় আক্রান্ত। এইচএসসি পর্যন্ত নিজে লিখেই পরীক্ষা দিতে পেরেছেন। কিন্তু তারপর থেকে চোখের সামনে সবকিছু ধূসর হতে থাকে। বর্তমানে সূর্যের আলোতে সামনের জিনিস কিছুটা দেখলেও ঘরের ভেতরে আবছা ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখেন না। চার বোনের মধ্যে তাঁর ছোট বোনেরও একই সমস্যা।

অস্ত্রোপচার করে সন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে চোখের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে চলে যায়। স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে বিয়ে, শেষ বর্ষের পরীক্ষার সময় সন্তানের জন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হিসেবে সুরাইয়াকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এক শিক্ষক তো সরাসরিই বলে দিয়েছিলেন, যেহেতু চোখে দেখে না, তাই পড়াশোনার দরকারটা কী। এ সময় বিভিন্নভাবে পাশে দাঁড়ায় পিডিএফ।

সুরাইয়া বলেন, ‘আমি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলেও আমার পরে যে শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন, তাঁদের এ পথ পাড়ি দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে।’ চোখের সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হলেও সুরাইয়া ঠিকই সামলে চলছেন সংসার ও সন্তান পালনের দায়িত্ব। রান্নাঘরের সব জিনিস ঠিক জায়গায় থাকলে অনুমান করেই রান্না করেন। পাশ থেকে স্বামী মিজানুর জানালেন, এমনকি ইউটিউব থেকে নতুন নতুন রান্নার রেসিপি অনুযায়ী রান্নাও চলে পুরোদমে। সবকিছুতে স্বামীর সহযোগিতার হাত যে আছে, তা তাঁদের কথোপকথনেই বোঝা যাচ্ছিল।

শুধু সংসার নয়, দেশে সুরাইয়া উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের স্বপ্নের সংগঠন পিডিএফকে একটি ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন সুরাইয়া আক্তার। সুরাইয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছেন—এমন ব্যক্তিরা তাঁদের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে আমিই প্রথম পিএইচডি করলাম। আর এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আমিই প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হিসেবে পিএইচডি শেষ করলাম। আমি প্রথম কি না জানি না, তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আমি পিএইচডি শেষ করতে পেরেছি, সেটাই বড় কথা।’

সুরাইয়া আক্তার রেটিনার সমস্যায় ভুগছেন। চার বোনের মধ্যে তাঁর আরেক বোনও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সুরাইয়া জানান, ঘরের মধ্যে আলো জ্বালানো থাকলে তিনি হয়তো বুঝতে পারেন তাঁর সামনে একটি বিছানার চাদর আছে, তবে তার প্রিন্ট বা নকশা বুঝতে পারেন না। আস্তে আস্তে সামনের সবকিছু ধূসর থেকে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি এ সত্যকে মেনে নিয়েছেন। প্রতিবারই ‘আমি পারব’—এটি প্রতিষ্ঠিত করেই তাঁকে এগিয়ে যেতে হয়েছে।

ছোট ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে পিএইচডি শেষ করতে পারার পেছনে স্বামী মিজানুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সুরাইয়া। তিনি জানান, পিএইচডি শেষ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর স্বামীর চাকরি হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকেও একটি চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে। তবে আপাতত ছয় মাস তিনি তাঁর দুই ছেলেকে সময় দেবেন। বড় ছেলের বয়স সাড়ে আট বছর আর ছোট ছেলের বয়স আড়াই বছর।

সুরাইয়া আরও জানান, ২০১৭ সালে তাঁর স্বামী শিকাগোর ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হলেও তিনি সে বছর ভর্তি না হয়ে পরের বছর ভর্তি হন। এই সময়ে তিনি তাঁকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করেন। তারপর দুজন একসঙ্গেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে পিএইচডি করতে আসেন।

স্বামী মিজানুর রহমান সব সময় সুরাইয়ার পাশে থাকছেন। দুই ছেলে মাকে কতটুকু বুঝতে পারে—এ প্রশ্নে সুরাইয়া বলেন, ‘শুধু আমার দুই ছেলে নয়, আমার বোনের বাচ্চারাও কীভাবে যেন বুঝে গিয়েছিল আমার সীমাবদ্ধতার কথা। আমার আড়াই বছর বয়সী ছোট ছেলেও তার কিছু লাগলে বা শরীরের কোনো জায়গায় সমস্যা হলে আমার হাতটি নিয়ে সেখানে ধরে তা বোঝানোর চেষ্টা করে।’

দেশে ফিরবেন কি না—এ প্রশ্নে কিছুটা থামলেন সুরাইয়া। বলেন, ‘পিএইচডি করে দেশে ফিরলেও হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানের রিসেপশনিস্ট হিসেবে চাকরি পাব, এর বেশি কিছু তো হওয়া সম্ভব নয়। তাই আপাতত দেশে ফেরার ইচ্ছা নেই। তবে প্রতিবন্ধিতা, প্রতিবন্ধী নারীর অধিকার রক্ষা—এসব বিষয় নিয়ে সব সময় কাজ করে যাব।’

Leave a Comment