
পরিশ্রম
ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। সর্বক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের মূল ফোকাস। উৎপাদনের ৪টি উপাদানের মধ্যে ইসলামে অন্যতম প্রাইম উপাদান শ্রম। যে কারণে ইসলামে শ্রমনীতির মূল উদ্দেশ্য শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। হাদিসে এসেছে কোনো বান্দার হক কেউ নষ্ট করলে সেই বান্দা ক্ষমা না করলে মহান আল্লাহও ক্ষমা করবেন না।
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের গুরুত্ব এবং জুলুম করার পরণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিজিক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের উপর আমি তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি।’ [সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৭০]
‘আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাইনি, বরং তা তোমাদেরই। আমার প্রতিদান তো কেবল আল্লাহর নিকট এবং তিনি সব কিছুর উপরই সাক্ষী। [সূরা সাবা’, আয়াত : ৪৭]
“সুনিশ্চিতভাবে মানুষকে আমি শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।” [সূরা বালাদ : ৪]
‘অতঃপর নারীদ্বয়ের একজন লাজুকভাবে হেঁটে তার কাছে এসে বলল যে, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যেন তিনি আপনাকে পারিশ্রমিক দিতে পারেন, আমাদের পশুগুলোকে আপনি যে পানি পান করিয়েছেন তার বিনিময়ে’। [সূরা আল-কাসাস, আয়াত : ২৫]
‘আর সকলের জন্যই তাদের আমল অনুসারে মর্যাদা রয়েছে। আর আল্লাহ যেন তাদেরকে তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দিতে পারেন। আর তাদের প্রতি কোন যুলম করা হবে না।’ [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত : ১৯]
‘তবে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন প্রতিদান’। [সূরা আত-তীন, আয়াত : ৬]
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের চুক্তিসমূহ পূর্ণ কর”। [সূরা আল-মায়িদাহ: ১]
‘আর আল্লাহ বান্দাদের উপর কোন যুলম করতে চান না।’ [সূরা আল-মু’মিন, আয়াত : ৩১]
‘আর অবশ্যই আমি তোমাদের পূর্বে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি, যখন তারা যুলম করেছে।’ [সূরা ইউনুস, আয়াত : ১৩]
নারীদ্বয়ের একজন বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনি তাকে মজুর নিযুক্ত করুন। নিশ্চয় আপনি যাদেরকে মজুর নিযুক্ত করবেন তাদের মধ্যে সে উত্তম, যে শক্তিশালী বিশ্বস্ত’। [সুরা কাসাস :২৬]
‘সুতরাং ঐগুলো তাদের বাড়ীঘর, যা তাদের যুলমের কারণে বিরান হয়ে আছে’। [সূরা আন-নামল, আয়াত : ৫২]
‘আর তুমি তাদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও। যখন তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে দুঃখ, কষ্ট সংবরণ অবস্থায়। যালিমদের জন্য নেই কোন অকৃত্রিম বন্ধু, নেই এমন কোন সুপারিশকারী যাকে গ্রাহ্য করা হবে। [সূরা আল-মু’মিন, আয়াত : ১৮]
‘আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই’। [সূরা আল-হাজ, আয়াত : ৭১]
‘সুতরাং তোমরা পরিমাণে ও ওজনে পরিপূর্ণ দাও এবং মানুষকে তাদের পণ্যে কম দেবে না; আর তোমরা যমীনে ফাসাদ করবে না তা সংশোধনের পর’। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ৮৫]
হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“ধনী ব্যক্তির (পক্ষ থেকে কারও পাওনা প্রদানে) টাল-বাহানা করা জুলুম; আর যখন তোমাদেরকে কোনো আদায় করতে সক্ষম ব্যক্তির প্রতি ন্যস্ত করা হয়, তখন সে যেন তার অনুসরণ করে” [বুখারী, হাদীস নং ২২৮৭; মুসলিম, হাদীস নং ১৫৬৪]
জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাকো, কারণ জুলুম কিয়ামতের দিন অনেক অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে।’ [মুসলিম : ৬৭৪১]
আবূ মূসা আশ‘আরী রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ জালেমকে অবকাশ দেন। অবশেষে যখন তাকে পাকড়াও করেন তখন তার পলায়নের অবকাশ থাকে না।’[বুখারী : ৪৬৮৬]
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের অধীনস্তদের প্রতি খেয়াল রাখবে। তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদেরও তা পরাবে’। (মুসলিম, তিরমিজি)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা ঘাম শুকানোর আগে শ্রমিককে তার মজুরি দিয়ে দাও। ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-২৪৪৩।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। অপর ব্যক্তি, যে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করেও তার পারিশ্রমিক দেয় না। বুখারি, হাদিস নং ২২২৭।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার অধীনস্থদের নিকট উত্তম।”
“তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ্ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন, তাকে তাই খাওয়াতে হবে, যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরতে দিতে হবে যা সে নিজে পরিধান করে।” [সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম]
ইসলামে কোন কাজকেই ঘৃণা করেনি। শ্রমের বিনিময়ে উপার্জনকে মহানবী শ্রেষ্ঠতম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “শ্রমজীবীর উপার্জনই শ্রেষ্ঠতর যদি সে সৎ উপার্জনশীল হয়।” তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “কোন ধরনের উপার্জন শ্রেষ্ঠতর? তিনি জবাব দিলেন, নিজের শ্রমলব্ধ উপার্জন।”
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের কারোর নিজ পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করা কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। তাকে (প্রার্থীকে) সে কিছু দিক বা না দিক।” বুখারি : ২/৭৩০
ভিক্ষার প্রতি নিরুৎসাহিত করে ভিক্ষার হাতগুলোকে শ্রমিকের হাতে রূপান্তর করেছেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হবে যে সে কখনো ভিক্ষা করবে না, তার জান্নাতের ব্যাপারে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করব।” আবু দাউদ : ২/৪২৭
ইসলামে শ্রমিকের আরেকটি প্রণিধানযোগ্য অধিকার হলো লভ্যাংশের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব লাভ করা। এ ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।” মুসনাদে আহমাদ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামশ্রম দিয়ে জীবিকা অর্জন করার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে বলেন, “কারও জন্য নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য বা খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) নিজ হাতের কামাই খেতেন।” [বুখারী, মিশকাত :২৭৫৯]