থাইরয়েড অনেক বেড়ে গেলে কী করবেন

শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থি থাইরয়েড। দেহে থাইরয়েড হরমোন বেড়ে গেলে বিভিন্ন সমস্যা হয়। থাইরয়েড গ্রন্থির নিঃসরণ বেড়ে গেলে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটাকে থাইরোটক্সিকোসিস বলে। গ্রেভস রোগ, থাইরয়েডের নডিউল, থাইরয়েডের প্রদাহ বিভিন্ন কারণে এটি হতে পারে। এটি সাধারণত নারীদের বেশি হয়।

থাইরয়েড গ্রন্থি একটি এনড্রোক্রাইন গ্ল্যান্ড। মানুষের গলার সামনে এটি অবস্থিত। এখান থেকে থাইরয়েড হরোমন তৈরি হয়। শরীরের সব রেচন প্রক্রিয়ায় এই হরমোন সাহায্য করে।

শিশুদের ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করলে শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। কোনো শিশু যদি ছোট বেলা থেকে এর ঘাটতিতে ভোগে তাহলে সে প্রতিবন্ধী হয়ে বড় হবে। যদি তাকে চিকিৎসা দেওয়া না হয় সে বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাবে।

জন্মগতভাবেই যদি বাচ্চার থাইরয়েড গ্রন্থি তৈরি না হয়, অথবা ভুলভাবে তৈরি হয়, ঠিক মতো বৃদ্ধি না পায়, কিংবা তৈরি হলেও ঠিকমতো কাজ না করে, তাহলে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হবে না। সে ক্ষেত্রে বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যহত হবে।

আর বড়দের ক্ষেত্রে থাইরয়ড গ্রন্থির বিভিন্ন রকম রোগ হতে পারে। থাইরয়েড যে হরমোন তৈরি করছে এটি একটি স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে থাকবে। থাইরয়েড হরমোন যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম তৈরি হয়, একে বলা হয় হাইপোথাইরয়েডিজম। এতে বিভিন্ন রকম অসুবিধা হয়। আবার যদি বেশি তৈরি হয়, তাকে বলা হয় হাইপার থাইরয়েডিজম। সেখানে আবার নানা রকম সমস্যা হবে। এটি হচ্ছে কাজঘটিত সমস্যা।

এ ছাড়া যে সমস্যা হতে পারে, থাইরয়েড গ্রন্থি নিজেই বড় হয়ে যেতে পারে। যাকে আমরা বলি গলগণ্ড। এখানে থাইরয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে যায়। এটি বিভিন্নভাবে বড় হতে পারে, বিভিন্ন কারণে বড় হতে পারে। আয়োডিনের অভাবে এটি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি গয়েটার বা এনডিমিক গয়েটার হয়। গ্রন্থিটি সমানভাবে বড় হয়ে যেতে পারে।

আয়োডিন যেহেতু হরমোন তৈরির বিশেষ একটি উপাদান। আয়োডিন যদি কম থাকে গ্রন্থি চেষ্টা করবে শরীরের হরমোনকে স্বাভাবিক রাখতে। সেই ক্ষেত্রে সে আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাবে। যাকে হাইপারট্রোফি বলা হয়। গ্রন্থি বড় হয়ে যাবে। তবে হরমোন স্বাভাবিকভাবে বের করার চেষ্টা করবে। করতে করতে এক সময় আর স্বাভাবিকভাবে তৈরি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েডিজম হয়ে যাবে। যদি লবণের মাধ্যমে আয়োডিন থাকার কারণে আমাদের দেশে এই রোগ অনেকটা কমে গেছে।

এছাড়া থাইরয়েড গ্রন্থিতে টিউমার হতে পারে। যেটিকে নডিউল বলা হয়। সিঙ্গেল (একটি) নডিউল হতে পারে, মাল্টিপল (অনেক) নডিউল হতে পারে। সিঙ্গেল নডিউল হলে একটি কারণে হয়। যেমন ফলিকুলার এডিনোমা। এটি বেনাইন ধরনের। সিস্ট হতে পারে। কলোয়েড গয়েটার হতে পারে। এগুলো সবই ক্যানসার তৈরিকারী নয়। তবে অনেক সময় ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। যাকে সাধারণত থাইরয়েড ক্যানসার বলা হয়।

হাইপোথাইরয়েডিজম হলে যা হতে পারে : যেহেতু থাইরয়েড হরমোন আমাদের শরীরের বিপাকে সাহায্য করে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কাজকর্ম করতে সাহায্য করে, সেজন্য যখন থাইরয়েড হরমোন কম থাকবে বা হাইপোথাইরয়েডিজম হবে, সে ক্ষেত্রে সব কাজকর্ম ধীর গতির হয়ে যাবে। ধীর গতির হয়ে গেলে রোগী দুর্বল হবে। রোগীর ওজন বেড়ে যাবে। কোষ্টকাঠিন্য হবে। পালস রেট কমে যাবে। সহজেই তার শীত লাগবে। যদি হাইপো হয়, কাজ কমে যায় তাহলে এই ধরনের সমস্যা থাকবে।

আর যদি কাজ বেড়ে যায়, যেটা হাইপার থাইরয়েডিজম সেখানে থাইরয়েড গ্রন্থি বেশি বেশি কাজ করবে, সব পদ্ধতির কাজগুলো বেড়ে যাবে। রোগী তখন অস্থির হয়ে যাবে। তার পালস রেট বেড়ে যাবে। পালপিটেশন হবে, হাত কাঁপবে। তার বাউয়েল মুভমেন্ট বেড়ে যাবে। বারেবারে পায়খানা হবে। আর তার ওজন কমে যাবে তবে ক্ষুধা বেশি থাকবে। গরম লাগবে, অস্থির ও দুর্বল লাগবে।

উপসর্গ
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন ও ট্রাই-আয়োডো থায়রোনিন নামক হরমোন নিঃসরণ হয়। কোনো কারণে এসব হরমোনের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে নানা উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। যেমন ওজন হ্রাস, অতিরিক্ত ঘাম, অতিরিক্ত গরম লাগা, বুক ধড়ফড় করা ইত্যাদি।

অস্থিরতা, খিটখিটে মেজাজ, হাতের কাঁপুনি।

দ্রুত নাড়িস্পন্দন এমনকি এলোমেলো নাড়িস্পন্দন (এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন) হতে পারে। এ থেকে হৃৎপিণ্ড বিকল হয়ে যেতে পারে।

হার্টের রোগ থাকলে থাইরোটক্সিকোসিস সেটিকে আরও উসকে দেয়। সামান্য হাঁটলেই হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে আসে।

নারীদের মাসিক অনিয়মিত হয়; এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।

কখনো কখনো শ্বাসকষ্টের অনুভূতি হতে পারে।

মাংসপেশির ক্ষয় বেড়ে যায়, সক্ষমতা কমে যায়। দ্রুত হাড় ক্ষয় হয়।

চোখের ওপরে থাইরয়েড হরমোন বিরাট প্রভাব ফেলে। অক্ষিগোলক বড় হয়ে যায়। খসখসে অনুভূতি হয়। চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। চোখের ওপরের পাতা ওপরের দিকে টেনে ওঠার কারণে চোখের সাদা অংশ দেখা যায়।

যেভাবে নির্ণয়
রক্ত পরীক্ষায় থাইরয়েডের হরমোন বেশি পাওয়া গেলে জানা দরকার কেন এমনটি হচ্ছে। কারণভেদে চিকিৎসা ভিন্ন হতে পারে। কারণ নির্ণয় করা খুবই জরুরি।

প্রয়োজন হয় বাড়তি কিছু পরীক্ষারও। এগুলোর মধ্যে আছে থাইরয়েডের স্ক্যান, রেডিও আয়োডিন আপটেক, অ্যান্টিবডি টেস্ট ইত্যাদি।

চিকিৎসা
তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে। ওষুধ, শল্য ও রেডিও আয়োডিন চিকিৎসা।

রোগীর বয়স, লিঙ্গ, রোগের কারণ ও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে চিকিৎসার ধরন।

ক্ষেত্রবিশেষে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হয়। বারবার ফলোআপের দরকার হয়।

নিউক্লিয়ার মেডিসিনে থাইরয়েডের যেসব পরীক্ষা করে থাকে, তার মধ্যে প্রথম হলো থাইরয়েডের হরমোন। টিথ্রি, টিফোর, ফ্রি টিথ্রি, থ্রিটিফোর এবং থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে টিএসএইচ- এই হরমোনগুলোর করা হয়।

এ ছাড়া নির্দিষ্ট পরিমাণ তেজস্ক্রিয় আয়োডিন রোগীকে খাওয়ানোর পরে, নির্দিষ্ট সময় পরে কত শতাংশ আপটেক হচ্ছে থাইরয়েড গ্রন্থিতে এটি দেখা হয়। দেখে বলা যায় এর কার্যকারিতা কম, না কি বেশি। যেমন : হাইপার থাইরয়েডিজমে আপটেকটা বেড়ে যাবে। হাইপো থাইরয়েডিজমে কমে যাবে।

তারপর থাইরয়েডের স্ক্যান করা হয়। এখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ তেজস্ক্রিয় আয়োডিন রোগীকে দেয়া হয়। মুখে দেয়, কিছু ইনজেকশনের মাধ্যমে দেয়। এটি দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় পরে আমরা গামা ক্যামেরা দিয়ে স্ক্যান করা হয়। গামা ক্যামেরা হলো এমন একটি ক্যামেরা যে গামা-রে নিতে পারে। যেহেতু তেজস্ক্রিয় আইসোটো রোগীকে রেডিয়েশন দেয়া হয়, এখান থেকে গামা-রে নির্গত হচ্ছে।

এখন এই গামা ক্যামেরা গামা-রে-কে তুলে নেবে। পরবর্তীকালে ছবি হিসেবে দেবে। এখন স্ক্যানের মাধ্যমে দেখা হয় থাইরয়েড গ্রন্থিটা বড় কি না। তার অবস্থানটা ঠিক আছে কি না। তার কার্যক্রম ঠিক আছে কি না।

আর যদি কোনো নডিউল থাকে, এর কার্যকারিতা কেমন সেটি দেখা হয়। অর্থাৎ নিডিউলটা কাজ করছে, নাকি কাজ করছে না। এই সব কিছুই এর মাধ্যমে দেখা যায়।

থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা বাড়াতে শরীরে যে জিনিসগুলোর মাত্রা বেশি হওয়া প্রয়োজন-

জিঙ্ক

আয়োডিন

অ্যালগি

কপার

আয়রন

কোন খাবার এড়িয়ে চলবেন-

বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকোলি, ছোলা জাতীয় খবার থাইরয়েড বাড়ায়। এ ছাড়াও সর্ষে, মুলো, রাঙা আলু, চিনে বাদাম এড়িয়ে চলাই ভাল। থাইরয়েড বেড়ে গেলে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার যেমন পনির, চিজ ডায়েট থেকে বাদ দিন। চিনি, রান্না করা গাজর, পাকা কলা, শুকনো ফল, মধু, ময়দার রুটি, সাদা ভাত, আলু, সাদা পাস্ত, মিষ্টি শরীরে কার্বহাইড্রেটের মাত্রা বাড়ায়। থায়রয়েড থাকলে এগুলোও কম খান। চা, কফি, চকোলেট, সফট ড্রিঙ্ক যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।

থাইরয়েড থাকলে আদর্শ ডায়েট-

কপার এবং আয়রন দুটোই থাইরডের মোকাবিলা করতে জরুরি। টাটকা মাংস, ওয়েস্টার, কাজু, গমের আটা, কোকতে প্রচুর পরিমাণে কপার রয়েছে। সবুজ শাকসবজি, বিন, আঁশওয়ালা মাছ, সামুদ্রিক মাছ, পোলট্রির ডিমে রয়েছে আয়রন। সেই সঙ্গেই ভিটামিন সি ব্যালান্স করতে খান লেবু, টমেটো, ক্যাপসিকাম খান। আগে নারকেল বা নারকেলের দুধ থায়রয়েডের আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে থায়রয়েড বশে রাখতে স্ট্রেস কমানোর প্রয়োজন রয়েছে। তাই থায়রয়েড কমাতে মাথা ঠান্ডা রাখা জরুরি।

Leave a Comment