
মাছ
গোটা পৃথিবীজুড়ে অন্যতম যে খাবারটি খাওয়া হয়, সেটি হলো মাছ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা প্রজাতির মাছ দেখা যায়। স্থানভেদে বিভিন্ন মাছের স্বাদও ভিন্ন। মানবদেহে প্রোটিনের অন্যতম একটি উৎস মাছ। এতে রয়েছে নানান পুষ্টিগুণ যা আমাদের শরীর সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। মাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিনসহ যথেষ্ট পরিমাণ চর্বি, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস ইত্যাদি কার্যকর উপাদান পাওয়া যায়।
একাধিক গবেষণা মতে, দৃষ্টিশক্তি, স্মৃতিশক্তি ও মস্তিস্কের পুষ্টি বৃদ্ধিতে মাছের উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রয়েছে। মাছের তেলে রয়েছে পলি আনস্যাচুরেটেড এসেনশিয়াল ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যাকে প্রচলিত ভাষায় আমরা ওমেগা থ্রি’জ বলি। এছাড়া সামুদ্রিক মাছ, পুকুর ও নদীর কিছু তৈলাক্ত মাছে ডিএইচএ এবং ইপিএ পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। ফলে মাছ নিয়মিত খেলে হার্টও ভালো থাকে।
মাছে পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকায় স্বাস্থ্যকর পেশী, অঙ্গ এবং রক্তনালিগুলির গঠন বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া প্রোটিন কোষ বিভাজন, চুলের বৃদ্ধি এবং হরমোন সংকেতকে সহায়তা করে।
সামুদ্রিক মাছ আয়োডিন সমৃদ্ধ হওয়ায় অত্যন্ত আদর্শ এটি খাবার। মাছে এসব পুষ্টি উপাদান ছাড়াও রয়েছে- ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি ১২, আয়রন, ফসফরাস, আয়োডিন।
মাছ খাওয়ার যত স্বাস্থ্য উপকারিতা :
মাছের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ,খনিজ এবং ফ্যাটি অ্যাসিড যেগুলো সুস্থতার জন্য সহায়ক।
মাছে থাকা ভিটামিন বি ১২ সুস্থ লোহিত রক্ত কনিকা, ডিএনএ, প্রজনন এবং নার্ভ ফাংশন বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
মাছ ক্যান্সার প্রতিরোধ করে : মাছের তেলে প্রচুর পরিমাণে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। গবেষণা মতে, মাছে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড ব্রেস্ট,কোলন, প্রস্ট্রেট,অগ্নাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
ঘুম ভালো হয় : বর্তমান সময়ে ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। নিয়মিত চর্বিযুক্ত মাছ (স্যামন) খেলে ঘুমের মান উন্নত হয়।
মাছ ব্রেনের শক্তি বৃদ্ধি করে : মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি আসিড মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত মাছ খেলে ডিএইচএ ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়। মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাছাড়া মাছের চর্বি বার্ধক্যজনিত মস্তিস্কের রোগ আলজিমার ও পারকিন্সন প্রতিরোধ করে। মাছে ভিটামিন এ, ডি, বি, রয়েছে। বিশেষ করে ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন বি ৬, ভিটামিন বি৩, ফোলেট রয়েছে যা ব্রেন ভালো রাখে ও ব্রেনের কোষগুলোতে শক্তি সরবরাহ করে।
মাছ শিশুদের হাঁপানি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে : শ্বাসনালীর দূর্ঘস্থায়ী প্রদাহের ফলে সৃষ্টি হয়ে হাঁপানি রোগের জন্ম। বেশ কিছু গবেষণায় বলা হয়, যেসব শিশুরা নিয়মিত মাছ খায় তাদের হাঁপানির ঝুঁকি ২৪% কম থাকে।
মাছ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে : স্ট্রেস বা মানসিক চাপ আমাদের দেহের নানা রোগের অন্যতম একটি কারণ। বর্তমানে সমাজে মানসিক চাপে ভোগার পরিমান বেড়েই চলছে। নিয়মিত মাছ খেলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
মাছে থাকা ভিটামিন বি ১২ মানসিক স্বাস্থ্যর জন্য ভালো ।
মাছ নায়াসিন স্নায়ুতন্ত্রকে ভালো রাখতে সাহায্য করে । সামুদ্রিক মাছে আয়োডিন রয়েছে যা থাইরয়েড গ্রন্থির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সামুদ্রিক মাছ খাওয়া দরকার। সিজিওফ্রেনিয়া একটি মানসিক রোগ মাছের তেল গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব।
মাছ ভিটামিন ডি এর ভালো উৎস : ভিটামিন ডি এর অন্যতম একটি উৎস মাছ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০% মানুষের ভিটামিন ডি এর চাহিদা মিটে মাছ থেকে। কড লিভার ওয়েল, স্যামন, হারিং ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
মাছ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে : মাছের চর্বি অ্যান্টি- ইনফ্লামেটরি গুণ সম্পূর্ণ। তেলযুক্ত মাছ টাইপ ১ এবং টাইপ -২ ডায়াবেটিস উভয়ই রক্ষা করতে পারে। মাছের তেলের ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোর মধ্যে রয়েছে ইকসাপেন্টানইক অ্যাসিড (ইপিএ), ডকোসাহেক্সানইক অ্যাসিড (ডিএইচএ) এবং আলফা লিনোলিক অ্যাসিড (এএলএ)। এসব উপাদান অটোইমিউন রোগ যেমন আর্থ্রাইটিস, ক্রোনস ডিজিস, করোনারি হৃদরোগ, সোরিইয়াসিস, লুপাস এরিথেটোসাস, মাইগ্রেনের মাথা ব্যথা প্রদাহজনিত রোগ প্রতিরোধ করে।
মাছ খারাপ কোলেস্টেরল কমায় : মাছ খেলে ভালো কোলেস্টেরল এইচ ডি এলের (HDL) মাত্রা বাড়ে আর খারাপ কোলেস্টেরলের (LDL) পরিমান হ্রাস পায়। নিয়মিত মাছ খেলে উচ্চরক্তচাপ এর ঝুঁকি কমে। গবেষণা বলছে, মাছের তেল থেকে প্রতিদিন যে ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায় তা ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা ২৫ %-৩০% হ্রাস করতে পারে।
মাছ হার্টকে ভালো ও সুস্থ রাখে : মানুষের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক। গবেষণা মতে, যারা নিয়মিত মাছ খান তাদের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং হৃদরোগ থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে। কানাডার হ্যামিলল্টনের ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এপিডেমিওলজিস্ট অ্যান্ড্রু মেন্ট বলেছেন, “কার্ডিওভাস্কুলার রোগে আক্রান্তদের মধ্যে মাছ খাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামুলক সুবিধা রয়েছে।”
তৈলাক্ত মাছের মধ্যে সালমন, টুনা, ম্যাকরেল এবং সার্ডাইন রয়েছে। এইসব মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। নিয়মিত মাছ খেলে হৃদ রোগের ঝুঁকি ৩৬ % কমে। হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ঝুঁকি ১২ % কমে।
মাছ বিষন্নতা কমাতে সাহায্য করে : অধিকাংশ মাছই ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ হওয়ায় বিষন্নতা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
মাছ থাইরয়েড গ্রন্থির জন্যউপকারি : সামুদ্রিক মাছে আয়োডিন রয়েছে। আয়োডিন থাইরয়েড সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও মাছে সেলেনিয়াম আছে যা থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন সংশ্লেষণ ঠিক রাখতে সহায়ক।
মাছ হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি : মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি যা অস্টিওপোরেসিস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। মাছের ভিটামিন এ সুস্থ হাড় ও দাঁতের গঠনে ভুমিকা পালন করে। সালমন, টুনা, সার্ডিন, ম্যাকরেল ইত্যাদি মাছে ভিটামিন ডি রয়েছে ।মাছের হাড়ে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে যা রিকেটস প্রতিরোধে সহায়ক।
মাছ ত্বক ভালো রাখে : তেলযুক্ত মাছ স্বাস্থ্যকর ত্বকের জন্য চমৎকার একটি খাবার। তৈলাক্ত মাছে থাকা ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে। এটি সানবার্ন হতে ত্বককে রক্ষা করে। চর্বিযুক্ত মাছ ভিটামিন ই এর দারুন উৎস । ত্বকের জন্য ভিটামিন ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। হাঙর মাছের তেলে স্কোয়ালিন নামক হাইড্রোকার্বন পাওয়া যায় যা ত্বকের জন্য ব্যবহৃত ক্রিম এর উপাদান।
মাছ দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে : নিয়মিত মাছ খেলে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (এএমডি) নামে একটি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যা বয়স্ক মানুষদের অন্ধত্বের একটি কারণ। গবেষণা মতে, যারা সপ্তাহে দুবার নিয়মিত মাছ খায় তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এছাড়াও মাছের তেলে ভিটামিন এ রয়েছে এটি রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে ।